Header Ads

JAHANARA HUQ MOHILA COLLEGE

জাহানারা হক মহিলা কলেজ

সাধু ও চলিত ভাষারীতির মধ্যে পার্থক্য। সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণ বা গুরুচণ্ডালী দোষ। সাধু ও চলিত ভাষারীতির নমুনা।

 

সাধু ও চলিত ভাষারীতির মধ্যে পার্থক্যঃ

সাধু ও চলিত ভাষারীতির মধ্যে ক্রিয়াপদ ও সর্বনামের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। উভয় রীতির বৈশিষ্ট্য থেকে অন্য পার্থক্যগুলোও ধরা পড়ে। যেমন :

সাধু ভাষারীতিঃ

১. সাধু ভাষারীতি প্রাচীন ও পুরনো বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।

২. সাধু ভাষারীতি ব্যাকরণের নিয়ম দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত।

৩. সাধু ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। ৩. যেমন : পড়িয়াছি, হাঁটিতেছি ইত্যাদি।

৪.সাধু ভাষারীতিতে সর্বনামের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। ৪. যেমন : ইহারা, উহাদের ইত্যাদি।

৫.সাধু ভাষারীতিতে তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি। ৫. যেমন : বৃক্ষ, চন্দ্ৰ, মৎস্য, হস্ত, মস্তক ইত্যাদি।

৬. সাধু ভাষারীতিতে অনুসর্গের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয় যেমন : হইতে, থাকিয়া ইত্যাদি।

৭.সাধু ভাষারীতিতে অব্যয় পদের তৎসম রূপ ব্যবহৃত  হয় । যেমন : যদ্যপি, তথাপি, বরঞ্চ ইত্যাদি।

৮. সাধু ভাষারীতিতে ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য নেই।

৯. সাধু ভাষারীতিতে সাধারনত কোনো অপিনিহিতি ও অভিশ্রুতির ব্যবহার নেই।

১০. সাধু ভাষারীতির পদবিন্যাস অপরিবর্তনীয়

১১. সাধু ভাষারীতি কথোপকথন, বক্তৃতা ও নাটকের সংলাপের উপযোগী নয়।

চলিত ভাষারীতিঃ

১. চলিত ভাষারীতি আধুনিক ও নতুন বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।

২. চলিত ভাষারীতি সব সময় ব্যাকরণের নিয়ম-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা গঠিত নয়।

৩. চলিত ভাষারীতিতে সাধারনত ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : ঘুমায়েছি, পড়েছি,খেয়েছি, হাঁটছি ইত্যাদি।

৪.  চলিত ভাষারীতিতে সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : এরা, ওদের ইত্যাদি।

৫.  চলিত ভাষারীতিতে তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের ব্যবহার | বেশি। যেমন : গাছ, চাঁদ, মাছ, হাত, মাথা ইত্যাদি।

৬. চলিত ভাষারীতিতে অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত বা অর্থবহুল রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : হতে, থেকে ইত্যাদি। 

৭. চলিত ভাষারীতিতে অব্যয় পদের তদ্ভব রূপ ব্যবহূত হয়। যেমন : যদি, তবু, বরং ইত্যাদি। 

৮. চলিত ভাষারীতিতে ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য আছে।

৯. চলিত ভাষারীতিতে অপিনিহিতি ও অভিশ্রুতির ব্যবহার আছে।

১০. চলিত ভাষারীতির পদবিন্যাস পরিবর্তনশীল।

১১. চলিত ভাষারীতি কথোপকথন, বক্তৃতা ও নাটকের সংলাপের উপযোগী।

সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণ বা গুরুচণ্ডালী দোষ।

বাংলা ভাষার প্রধান রূপ দুটি— সাধু ও চলিত। প্রথমটি শুধু লেখার ভাষা আর দ্বিতীয়টি লেখা এবং কথার ভাষা। লেখার সময় সাধু ও চলিত ভাষারীতিকে মিশিয়ে ফেলা হলে, সেই মিশ্রণকে গুরুচণ্ডালী দোষ বলে। ভাষারীতির এই মিশ্রণ দূষণীয়। কাজেই শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণ না ঘটে।

কবিতার ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণ দোষের বলে বিবেচিত হয় না। কবিতার ছন্দ ও মত্রা ঠিক রাখার জন্য নানা রকম শব্দ ব্যবহার করতে হয়। তাতে চলিতরীতির পাশে সাধুরীতির শব্দ অনেক সময় ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবার চরণের শেষে মিল রক্ষার জন্যও সাধু ও চলিত ভাষারীতির শব্দ এসে পড়ে। ফলে কবিরা এক্ষেত্রে অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করেন। যেমন :

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি

সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।

উপরের দুটি চরণের মধ্যে কেবল 'উঠিয়া' শব্দটি সাধু ভাষারীতির। 'উঠিয়া' শব্দের স্থলে যদি চলিত রূপের 'উঠে' ব্যবহার করা হতো, তবে ছন্দপতন ঘটত। তাই এখানে গুরুচণ্ডালীর ঘটনা ঘটলেও কবিতার কারণে তা দূষণীয় নয়। কিন্তু গদ্য রচনার ক্ষেত্রে এটি দূষণীয়। তাই শিক্ষার্থীদের সচেতনভাবে ভাষারীতির অনুশীলন করতে হবে। 

সাধু ভাষারীতির নমুনা

১. এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল, “শিগরির চলে আয় এই গাড়িতে জায়গা আছে।" মনে হইল, যেন গান শুনিলাম। বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায় আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু, এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের গল৷ বলিয়া একটি শ্রেণিভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একটি মানুষের গলা; শুনিলেই মন বলিয়া ওঠে, “এমন তো আর শুনি নাই।” অপরিচিতা ॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

২. শুনিতে পাই, দেড় শত বৎসর পূর্বে ভারতবাসী অসভ্য বর্বর ছিল, এই দেড় শত বৎসর হইতে আমরা ক্রমশ সভ্য হইতে সভ্যতর হইতেছি। শিক্ষায়, সম্পদে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ও জাতির সমকক্ষ হইতে চালিয়াছি। এখন আমাদের সভ্যতা ও ঐশ্বর্য রাখিবার স্থান নাই । “চাষার দুক্ষু” । রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

৩. এই অকিৎিকর কথার উল্লেখের তাৎপর্য এই যে, আমি বাল্যকালে, মধ্যে মধ্যে, অতিশয় অবাধ্য হইতাম। প্রহার ও তিরস্কার দ্বারা, পিতৃদেব আমার অবাধ্যতা দূর করিতে পারিতেন না। ঐ সময়ে তিনি সন্নিহিত ব্যক্তিদের নিকট, পিতামহদেবের পূর্বোক্ত পরিহাসবাক্যের উল্লেখ করিয়া, বলিতেন, “ইনি সেই এঁড়ে বাছুর; বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন, বটে; কিন্তু তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন; তাঁহার পরিহাসবাক্য ও বিল দুইবার নহে।” আত্মচরিত ৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

৪. মার্জারী মহাশয়া বলিলেন, “চোরকে ফাঁসি দাও, তাহাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম কর। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি আমাকে মারিতে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ”। ‘বিড়াল’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

৫. সুখের বিষয়, সম্প্রতি পল্লিগ্রামের দুর্গতির প্রতি দেশবন্ধু নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি পড়িয়াছে। কেবল দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট নহে, চাষার দুক্ষু যাহাতে দূর হয়, সেজন্য তাঁহাদিগকে বিশেষ চেষ্টা যত্ন করিতে হইবে। আবার সেই "মরাই- ভরা ধান, ঢাকা মসলিন" ইত্যাদি লাভ করিবার একমাত্র উপায় দেশি শিল্প– বিশেষত নারী শিল্পসমূহের পুনরুদ্ধার ।“চাষার দুক্ষু” ॥ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

৬. আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানালা খুলিয়া বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিলাম, কিছুই দেখিলাম না। প্লাটফর্মের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লণ্ঠন নাড়িয়া দিল, গাড়ি চলিল; আমি জানলার কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রূপ দেখিতে লাগিলাম। “অপরিচিতা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

চলিত ভাষারীতির নমুনা

১. শেষবেলায় খালে এমন পুরো ভাটা জল নেমে গিয়ে কাদা আর ভাঙা ইটপাটকেল ও ওজনে ভারি আবর্জনা বেরিয়ে পড়েছে। কংক্রিটের পুলের কাছে খালের ধারে লাগনো মালতি থেকে খড় তোলা হচ্ছে পড়ে। পাশাপাশি জোড়া লাগানো দুটো বড় সালতি বোঝাই আঁটিবাঁধা খড় তিনজনের মাথায় চড়ে গিয়ে জমা হচ্ছে ওপরের মস্ত গাদায়। ওঠানামার পথে ওরা খড় ফেলে নিয়েছে কাদায়। সালতি থেকে ওদের মাথায় খড় তুলে দিচ্ছে দুজন। একজনের বয়স হয়েছে, আধপাকা চুল, রোগা শরীর। অন্যজন মাঝবয়সী, হেঁটে, জোয়ান, মাথায় ঠাসা কদমহাটা রুক্ষ চুল।  “মাসি-পিসি”। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

২. ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলে। এই কথা বলে যে, আমার সাথে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌছালাম দেখি, একটু পরে মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পরে আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বায়ান্নর দিনগুলো ॥ শেখ মুজিবুর রহমান ৩. কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ পর সে বুঝতে পারে না, মিলিটারি তাকে ফের একই প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে প্রবল বেগে দুটো ঘুষি লাগায় তার মুখে। প্রথম ঘুষিতে সে কাত হয়, দ্বিতীয় ঘুষিতে পড়ে যায় মেঝেতে।
মেঝে থেকে তুলে তাকে মিলিটারি ফের জিজ্ঞেস করে, ওদের আস্তানা কোথায় সে খবর তার তো ভালোভাবেই জানা আছে। সে জবাব দেয়, 'হ্যাঁ!' রেইনকোট ॥ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ৪. আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি- নমস্কার করছি আমার সত্যকে। যে পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয় । রাজভয়লোভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি যদি সত্যি করে আমার সত্যকে চিনে থাকি, আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে, তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমার কিছু করতে পারবে না। “আমার পথ” ॥ কাজী নজরুল ইসলাম। 

৫. বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন। মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই। “জীবন ও বৃক্ষ” ৷ মোতাহের হোসেন চৌধুরী।

৬. জাদুঘর আমাদের জ্ঞান দান করে, আমাদের শক্তি জোগায়, আমাদের চেতনা জাগ্রত করে, আমাদের মনোজগৎকে সমৃদ্ধ করে। জাদুঘর একটা শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সমাজের এক স্তরে সঞ্জিত জ্ঞান তা ছড়িয়ে দেয় জনসমাজের সাধারণ স্তরে। গণতন্ত্রায়ণের পথও প্রশস্ত হয় এভাবে। জাদুঘর শুধু জ্ঞানই ছড়িয়ে দেয় না, অলক্ষ্যে ছড়িয়ে দেয় ভাবাদর্শ। “জাদুঘরে কেন যাব” ৷ আনিসুজ্জামান।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.