ক. সাধু ভাষারীতি : যে ভাষারীতিতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি এবং ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়, তাকে সাধু ভাষারীতি বলে। যেমন: করিয়াছি, খাইয়াছি, তাহারা, তাহাদের ইত্যাদি। সাধু ভাষারীতি শুধু লেখার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একে লেখ্য ভাষা বলা হয়।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সাধু ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, 'সাধারণ গদ্য-সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে। সাধু ভাষার সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, 'বাংলা ভাষার সংস্কৃত শব্দ-সম্পদ, ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ এবং ব্যাকরণসিদ্ধ উপাদান ব্যবহার করিয়া ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের পদবিন্যাস প্রণালীর অনুসরণে পরিকল্পিত যে নূতন সর্বজনীন গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হয়, তাহাকে বাংলা সাধু ভাষা বলে।
১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮০১ সালে বাংলা বিভাগ চালু হয়। এরপর বাংলা গদ্যচর্চা শুরু হয়। এসময়ে সাহিত্যের উপযোগী ভাষা হিসেবে বাংলা গদ্যের একটি আলাদা রূপ গড়ে ওঠে। সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে একক যে সাহিত্যিক ভাষা একমাত্র ব্যবহার্য ভাষা হিসেবে রূপ লাভ করে তা সাধু ভাষা নামে পরিচিত। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশন্নাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ সাধু ভাষার খ্যাতিমান সাহিত্যিক। →
সাধু ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য
১. সাধু ভাষারীতি সুনির্ধারিত ব্যাকরণ মেনে চলে।
২. সাধু ভাষারীতির পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।
৩. সাধু ভাষারীতিতে সাধারনত ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ গুলোর ব্যবহৃত হয়। যেমন : পড়িতেছি, যাইতেছি ইত্যাদি।
৪. সাধু ভাষারীতিতে সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ এর ব্যবহৃত হয়। যেমন : তাহারা, তাহাদের, উহারা, উহাদের ইত্যাদি।
৫. সাধু ভাষারীতিতে যথারীতি অব্যয়ের তৎসমরূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন : তথাপি, যদ্যপি ইত্যাদি।
৬. সাধু ভাষারীতি তৎসম শব্দবহুল এবং গুরুগম্ভীর।
৭. সাধু ভাষারীতি প্রাচীন।
৮. সাধু ভাষারীতিতে সাধাররনত সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার বেশি।
খ. চলিত ভাষারীতি : যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষারীতি বলে। যেমন : করেছি, খেয়েছি, তারা, তাদের ইত্যাদি। প্রমিত কথ্য ভাষারীর্তি অবলম্বনে গড়ে ওঠা একটি রীতি হলো চলিত ভাষারীতি।
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চলিত ভাষারীতির সংজ্ঞার্থ দিতে গিয়ে বলেন, 'দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজের ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকেই চলিত ভাষ৷ বলা হয় ।
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক চলিত ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, "তত্ব শব্দ, সঙ্কুচিত ক্রিয়া, হ্রস্বীকৃত সর্বনাম পদ এবং লেখকের মনোভাব অনুসারী পদবিন্যাস প্রণালির ব্যবহারসহ যে স্বচ্ছন্দ, চটুল ও সর্বজনীন সাহিত্যিক গদ্যরীতি কলিকাতা ও ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলের মুখের ভাষার আদলে গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহার নাম চলিত ভাষা।” সাধু ভাষারীত সমসাময়িক কালেই চলিত ভাষারীতির উদ্ভব হয়েছে শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষার সাথে মিল রেখে। ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী কলকাতা তখন সমগ্র বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল। সেখানকার শিক্ষিত সম্প্রদায় যে ভাষায় ভাব প্রকাশ করতেন, তাদের সেই মৌখিক ভাষাকেই সাহিত্যের বাহন হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা চলিত রূপ নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, বনফুল, কাজী নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ চলিত ভাষার খ্যাতিমান লেখক।
চলিত ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য
১. চলিত ভাষারীতি সাধারনত সবসময় ব্যাকরণের কোনো সুনির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে না।
২. চলিত ভাষারীতি পরিবর্তনশীল এবং পদবিন্যাস সুনির্দিষ্ট নয়।
৩. চলিত ভাষারীতিতে সাধারনত ক্রয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপ এই ব্যবহৃত হয়। যেমন : খাচ্ছি, পড়ছি, যাচ্ছি ইত্যাদি।
৪. চলিত ভাষারীতিতে সর্বনামের পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন: তারা, তাদের, ওরা, ওদের ইত্যাদি।
৫.চলিত ভাষারীতিতে অব্যয়ের তদ্ভব রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : তবু, যদিও ইত্যাদি।
৬.চলিত ভাষারীতি তদ্ভব শব্দবহুল এবং উচ্চারণ হালকা।
৭. চলিত ভাষারীতি আধুনিক।
৮. সাধারনত চলিত ভাষারীতিতে সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার কম হয়ে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই