ভাষার উপাদান | ধ্বনি | শব্দ | বাক্য | বাগর্থ | ভাষার প্রয়োজনীয়তা | মাতৃভাষা ও বাংলা ভাষা
ভাষার উপাদান
ভাষার
পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায় এক একটি বাক্যে।
বাক্য গঠিত হয় পদ বা শব্দ
সহযোগে। শব্দ আসে ধ্বনির সংযোগে। সেই সাথে থাকে শব্দের বিশেষ অর্থ। এদিক থেকে ভাষার চারটি উপাদান পাওয়া যায়। যেমন : ক. ধ্বনি, খ.
শব্দ, গ. বাক্য ও
ঘ. বাগর্থ।
ক. ধ্বনি
(Sound)
নানাভাবে ধ্বনির সৃষ্টি হয়। যেমন বাতাসের আঘাতে শুকনো পাতার ঝনঝন আওয়াজ, নদীর কুলকুল শব্দ, বিড়ালের মিউ মিউ ডাক— এগুলো সবই ধ্বনি। কিন্তু যেকোনো ধ্বনিই ভাষা নয়। মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিই ভাষায় ধ্বনি বলে বিবেচিত হয়। পশু-পাখির ডাক ভাষার ধ্বনি নয়। ভাষার ধ্বনি হতে হবে বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি অর্থবোধক ধ্বনি। এসব ধ্বনি পরিবর্তন করে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা যায়। যেমন 'চল' একটি শব্দ। 'চল' শব্দের 'চ' ধ্বনিটি পরিবর্তন করে 'জ’ জুড়ে দিলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে এমন শব্দ তৈরি হয়। এভাবে প্রথম ধ্বনি পরিবর্তন করে জল, ঢল, তল, নল, ফল, বল, মল ইত্যাদি শব্দ গঠন করা যায়। ফলে আমরা জ়, ঢ়, ত্, ন, ফ, ব, ম্ ধ্বনি পাই । ধ্বনি হলো ভাষার প্রথম এবং মূল উপাদান ।
খ. শব্দ
(Word)
এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবোধক সম্মিলনে তৈরি হয় শব্দ। যেমন 'মহাকরি' একটি শব্দ। এটি একটি ধ্বনিগুচ্ছ। যেমন : মৃ + অ + হ্ + আ + ক্ + অ + ণ্ + ই = মহাকবি। শব্দটি বিশ্লেষণ করে আটটি ধ্বনি পাওয়া গেল। এই ধ্বনিগুলো মিলেই 'মহাকবি' শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। এটি ভাষার দ্বিতীয় উপাদান।
গ. বাক্য
(Sentence )
বিভক্তিযুক্ত শব্দসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হলে তাকে বাক্য বলে। ধ্বনির মাধ্যমে যার যাত্রা শুরু, শব্দে তার সংহত রূপ এবং বাক্যে এসে তার পরিণতি। কোনো বক্তার মুখ থেকে উচ্চারিত বাক্য যদি শ্রোতার আকাঙ্ক্ষা মিটাতে পারে, তবেই বাক্যের সার্থকতা। যেমন : যে পরিশ্রম করে, সে-ই সুখ লাভ করে। বাক্য হচ্ছে ভাষার তৃতীয় উপাদান। শ্রোতার তৃপ্তি মেটে এমন বাক্য মিলেই তৈরি হয় ভাষা।
ঘ. বাগর্থ
(Semantic)
অনেক শব্দ আছে যার দুই রকমের অর্থ হয় আভিধানিক অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ। শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাষার প্রাণ। ভাষার পরিবর্তন যেমন তার বাহ্যিক ও আঙ্গিক পরিবর্তন, তেমনি তার ভেতরের প্রাণশক্তি অর্থেরও পরিবর্তন নানা কারণে শব্দের অর্থ-পরিবর্তন ঘটে। ভাব প্রকাশের জন্য আমরা নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার করি, কখনো কখনো একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে বিশেষ পরিবেশে বাক্যে ব্যবহারের সময় শব্দের মূল অর্থ পরিবর্তিত হয়ে নতুন অর্থ গ্রহণ করেছে। যেমন 'সন্দেহ' একটি শব্দ। এর মূল অর্থ, 'সম্যক দেহ' শব্দটি যখন বাক্যে এভাবে ব্যবহার করা হয় 'এই অচেনা লোকটার চালচলন আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়'- তখন 'সন্দেহ' শব্দের অর্থ দাঁড়ায় 'সংশয়'। ভাষার শব্দ ও বাক্যের অর্থ-পরিবর্তনসংক্রান্ত এসব বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনাকেই বলা হয় ৰাগৰ্থ।
ভাষার প্রয়োজনীয়তা
ভাষা হলো ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষ ভাষার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনের কথা বলে। ভাব প্রকাশের অন্যান্য মাধ্যম থাকলেও ভাষা ছাড়া তা পরিপূর্ণভাবে সম্ভব নয়। তাই ভাষা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষকে এটি অতি যত্নের সাথে লালন করতে হয়। জীবনধারণের জন্য মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন স্বাভাবিক ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি মানুষের মনের ভাব বিনিময় এবং পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্হাপনের জন্য ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশিষ্ট
ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই বলেন, 'ভাষা মানুষের জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা, দ্বন্দ্ব, আবেগ, উদ্বেগ, মানসিক চঞ্চলতা ও অন্তর্জীবনের সুখ-দুঃখের সংগীত, মূর্ছা ও মূর্ছনার ধারক
ও বাহক। ভাষাই মানুষের জীবনের বন্ধন ও মুক্তির সন্ধান
দিতে পারে, তার জীবনের রসাভাস ঘটাতে পারে ড. রফিকুল ইসলামের
মতে, “ভাষা মানবজাতির সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
সাহিত্য সৃষ্টি, শিক্ষাদান, সংবাদপত্র প্রকাশ, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা, দলিলপত্র লিখন, পাঠ্যগ্রন্থ প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় নথিপত্র লিপিবদ্ধকরণ এর কোনোটিই ভাষা
ছাড়া হয় না। বাংলাদেশের মানুষ এসব কাজ করে বাংলা ভাষায়। কাজেই প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর কাছে ভাষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
মাতৃভাষা ও বাংলা ভাষা
বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের ওপর ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা। শিশুকাল থেকে মায়ের মুখে শুনে সহজাতভাবে মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, তাকে আমরা মাতৃভাষা বা মায়ের ভাষা বলে থাকি। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎতম মাতৃভাষা।
আমরা
বাংলাদেশের অধিবাসী। আমাদের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের মানুষ যে ভাষায় কথা
বলে মনের ভাব প্রকাশ করে, তাকে বলে বাংলা ভাষা বাংলা ভাষার সংজ্ঞার্থ প্রদান করতে গিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'বাঙ্গালী জাতি যে ভাষা ব্যবহার
করে, তাহার নাম বাঙ্গালা ভাষা।
ডক্টর
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, "বাঙ্গালা দেশে, জাতি এবং ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙ্গালী জনসমাজে ব্যবহৃত শব্দ লইয়া বজ্ঞাভাষা বা বাঙ্গালা ভাষা
গঠিত।'
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন, 'পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার অধিকাংশ অধিবাসী তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় মনের ভাব আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহারই নাম বাংলা ভাষা।
বাংলাদেশ
ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি
অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র,
যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের
অনেক দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। বর্তমানে
পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা।
কোন মন্তব্য নেই